১৯ মে ২০২৫, ১২:৩৪:৪৯
– সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ, রাজস্ব কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ এবং গ্রন্থ প্রণেতা (ছদ্মনাম: বাদল সৈয়দ)
১। “আমার সন্তানরা যেনো আমাকে দেখে শিখে যে জীবনে যতই ঝড় আসুক পড়াশোনা শেষ করতেই হবে!” কথাটি আমার নয়। শ্রদ্ধেয় গুলতেকিন খানের। তিনি সম্প্রতি একটি ফেইসবুক পোস্টে এ মন্তব্য করেছেন। ( তাঁর অন্যকোনো পরিচয় দিলাম না, তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল) তাঁর কথা টেনে আনার কারণ হচ্ছে, আমার প্রায়ই মনে হয়, আজকের ছাত্রসমাজ কী পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝতে পারছে? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়, পারছে না। তাই আজকের লেখার অবতারণা।
২। পড়ালেখা মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে বোঝাই। কয়েক বছর আগের কথা। চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গেছি। তা শেষ করে যখন ডায়াস থেকে নেমে আসলাম তখন দেখি মিষ্টি একটি বিদেশি মেয়ে এগিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই বললো, ‘স্যার, মে আই টক টু ইউ?’ তার চেহারায় অদ্ভুত মায়া! চোখগুলো নীলচে, স্বচ্ছ চশমার কাচ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে উজ্জ্বলতা।
আমি বললাম, ‘সিউর, ইউ ক্যান।’
সে কিছুটা ইতস্তত করে বললো, ‘আমি আফগানিস্তান থেকে এসেছি। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পড়ি। এখন আমি কোরিয়ায় একটি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ প্রোগ্রাম সব খরচ কভার করে না। সেখানে তিন মাস থাকতে হলে কিছু খরচের টাকা প্রয়োজন। সে টাকা আমার নেই। ক্যান ইউ হেল্প মি?’
আমি বললাম, ‘মাই ডিয়ার ডটার, উই ডু নট হেল্প, উই স্ট্যান্ড বিসাইড। আমরা কাউকে সাহায্য করি না, পাশে দাঁড়াই। তুমি তোমার কাগজপত্র আমাকে মেইল করতে পারো?’
কিছুদিন পরই সে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে দক্ষিণ কোরিয়া চলে গেলো। তাকে ফান্ডিং করল রোটারি ক্লাব খুলশি, চট্টগ্রাম। ফিরে আসার পর কখন যে সে আমাকে ‘পা’ ডাকা শুরু করলো নিজেই জানি না। পাপা থেকে ‘পা’। আমিও তাকে খাস বাংলায় ডাকতাম ‘মা’। তার জীবনের সংগ্রাম, প্রতিকূলতা আমাকে আপ্লুত করত। আফগানিস্তানের একদম দুর্গম এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে সে দুহাতে সব বাধা ঠেলে এশিয়ান ইউনভার্সিটি ফর উইম্যানে পড়তে এসেছিল। সে যাত্রা শেষ হয়েছে কোথায় জানেন? ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নর্দান আইওয়া থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করার মাধ্যমে তা শেষ হয়েছিল। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের সবচে বিপণ্ণ শিক্ষার্থীকেও এই মেয়েটির মতো সংগ্রাম করতে হয় না। একটি রুটি আধখানা ভাগ করে দুবেলা খেতে হয় না। চামড়া গলে যাওয়ার মতো প্রখর সূর্যতাপে কয়েক মাইল হেঁটে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয় না। তবে তারা কেন পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছে না? তারা কি বুঝতে পারছে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়লে দশ বছর পর তাদের কী অবস্থা হবে? যৌবনের উম্মাদনায় অতীতে যারা পড়ায় মন দেয়নি, আমি তাদের আজকের অবস্থা পর্যবেক্ষণের অনুরোধ করি। সেই উদ্দাম তরুণদের বেশিরভাগ আজ অন্যের করুণা আর অপমানের মধ্যে বেঁচে আছে। হাতের কাছেই প্রমাণ আছে, আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা ছাত্র তারুণ্যের ঝলকানিতে কলেজে থাকতেই সারা দুনিয়া তার করতলে ভেবে পড়ায় মনোযোগ দেয়নি। এখন প্রায়ই তার মেসেজ পাই। সাহায্য প্রার্থনার মেসেজ। আমার খারাপও লাগে, তার অর্বাচীনতার জন্য বিরক্তও লাগে। আজ যারা তার মতো দুনিয়াকে নিজের পায়ের ফুটবল ভেবে ক্লাসে যাচ্ছে না, পরীক্ষা দিচ্ছে না, দশ/পনের বছর পর তাদেরও অন্যের করুণা ভিক্ষা করে মেসেজ দিতে হবে। এটা অনিবার্য পরিণতি।
৩। আমার বাবা বলতেন, ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের একমাত্র সুরক্ষা হলো শিক্ষা। তা যেধরনেই শিক্ষাই হোক।’ এর চেয়ে ধ্রুব সত্য আর কিছু নেই।পড়াশোনা ভালোভাবে শেষ করলে কোনো না কোনো গতি হয়। আর কিছু না হোক, টিউশনি করে জীবনযাপন করা যায়। অন্যের কাছে হাত পাততে হয় না।
৪। বাবা নামের মানুষটি বিনাপয়সায় যে হোটেল চালান তা একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। আজকের বিভ্রান্ত তরুণ সেদিন আবিষ্কার করবে দুনিয়া কত কঠিন! পাশে কেউ নেই!নিরন্তর যুদ্ধক্লান্ত বাবা কিংবা মা নেই, ভাইবোন নেই, বন্ধুরা নেই। প্রতিটি জীবন অনেক ওজনদার, তাই অন্যের জীবনের বোঝা আর কেউ বইতে পারেন না। সেটি নিজেকেই বইতে হয়। এটার জন্য প্রস্তুতি না নেওয়া মানে নিজের সর্বনাশ করা।
৫। একটি প্রশ্ন আমার মনে বারবার উঁকি দেয়, তাহলো, আফগানিস্তানের মেয়েটি যদি সকাল এবং দুপুরে একটি রুটির আধখানা ভাগ করে খেয়ে, রোদে পুড়ে, তীব্র শীতে চামড়া জ্বালিয়ে যাত্রা শুরু করে তা ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় শেষ করতে পারে, আমাদের সন্তানরা কেন অন্তত দেশে পড়াশোনাটা ভালোভাবে শেষ করতে পারবে না? কেন পড়ার সময়টা নষ্ট করে, অবহেলা করে তারা অন্ধকার ভবিষ্যতকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে?
৬। যারা পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারছে, তাদের আমার বলতে ইচ্ছে হয়, আজ থেকে দশ-পনের বছর পর অন্যের কাছে সাহায্য চেয়ে টেক্সট পাঠাতে কি তোমার ভালো লাগবে? জীবন তোমার, সিদ্ধান্তও তোমার। তবে মনে রেখো, করুণা নির্ভর জীবনের চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
আমি প্রার্থনা করি, এমন জীবন তোমার না হোক।
(শিক্ষা বলতে সবধরনের শিক্ষা বোঝানো হয়েছে, শুধু কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত শিক্ষা নয়।)
[ লেখকের বক্তব্যটি সকলের কাছে পৌঁছাবার জন্য এখানে প্রকাশ করা হল। শিক্ষার মাহাত্ম্য বুঝানোর জন্য মহৎ উদ্দেশ্যেই এর প্রচার। ]