১১ জুন ২০২৫, ১০:৫১:৩৪
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি তাদের সর্বশেষ ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস’ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির বাণিজ্য নীতি এবং শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ০.৪ শতাংশ কমে ২.৩ শতাংশে নামতে পারে। একইসঙ্গে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাসও কমানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (১০ জুন) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ এবং ছয়টি উদীয়মান অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানো হয়েছে, যা গত ছয় মাসের চিত্র থেকে একেবারেই ভিন্ন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ওঠানামা করা শুল্কনীতিই এই দুরবস্থার অন্যতম কারণ।
বিশ্বব্যাংক আরও জানায়, ট্রাম্পের সময়ে একের পর এক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে গড় শুল্কহার শতবর্ষের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে মধ্য-দশকের ঘরে ঠেকেছে। এর জবাবে চীনসহ বিভিন্ন দেশও মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
বিশ্বব্যাংক সরাসরি বৈশ্বিক মন্দার পূর্বাভাস না দিলেও সতর্ক করেছে যে, ২০০৮ সালের পর এই প্রথম মন্দা ছাড়া কোনো বছরে এত দুর্বল প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে। ২০২৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জিডিপি গড়ে বছরে ২.৫ শতাংশ হারে বাড়বে, যা ১৯৬০-এর দশকের পর সবচেয়ে ধীরগতির।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি কমে মাত্র ১.৮ শতাংশে দাঁড়াবে, যেখানে ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৩.৪ শতাংশ এবং ২০০০-এর দশকে গড় হার ছিল ৫.৯ শতাংশ। এপ্রিলের শুল্কবৃদ্ধির ঘোষণাগুলো এখনো এই পূর্বাভাসে ধরা হয়নি, যা ট্রাম্প ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন। শুল্ক ও শ্রমবাজারের চাপে ২০২৫ সালে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ২.৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
বিশ্বব্যাংকের উপ-প্রধান অর্থনীতিবিদ আইহান কস বলেছেন, “বাণিজ্য ঘিরে অনিশ্চয়তা যেন রানওয়েতে কুয়াশা। এটি বিনিয়োগকে মন্থর করে এবং বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিপথ ঝাপসা করে দেয়।” তবে তিনি আশাবাদী যে, বর্তমান অনিশ্চয়তা ধীরে ধীরে কেটে যাবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সরবরাহ শৃঙ্খলে নতুন অভিযোজন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে উন্নত দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি মাত্র ১.২ শতাংশে দাঁড়াবে, যা ২০২৪ সালের ১.৭ শতাংশের তুলনায় কম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস জানুয়ারির তুলনায় ০.৯ শতাংশ কমিয়ে ১.৪ শতাংশ করা হয়েছে। ইউরো জোনে প্রবৃদ্ধি ০.৭ শতাংশে এবং জাপানেও ০.৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো ২০২৫ সালে ৩.৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, যা জানুয়ারির ৪.১ শতাংশ পূর্বাভাস থেকে কম। দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে; ২০২৭ সাল নাগাদ তাদের মাথাপিছু জিডিপি কোভিড-পূর্ব স্তরের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ কম থাকবে। চীনকে বাদ দিলে, এসব দেশের ২০২০ দশকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দুই দশক লেগে যেতে পারে। মেক্সিকো, যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল, সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে, যেখানে প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ১.৩ শতাংশ কমিয়ে মাত্র ০.২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
অন্যদিকে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস জানুয়ারির ৪.৫ শতাংশেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বেইজিংয়ের হাতে এখনও আর্থিক ও মুদ্রানীতিগত সহায়তার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বিশ্ব অর্থনীতি এই মুহূর্তে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে অনিশ্চয়তার ভারে চরম চাপের মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক সংলাপ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।