২৭ জুলাই ২০২৫, ২:৩৫:১৫
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সংস্কারের পরও ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন (USCIRF)। গত ২১ জুলাই প্রকাশিত এক বিস্তারিত প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা এখনো বিদ্যমান, যা ভবিষ্যতের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও নতুন সরকারের অঙ্গীকার: প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একই বছরের আগস্টে সেনাবাহিনীর সমর্থনে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে সরকার একাধিক সংশোধনী, সংস্কার ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব দিলেও, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগগুলো এখনো অমীমাংসিত।
USCIRF প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণ: চলতি বছরের মে মাসে USCIRF-এর একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে, অধ্যাপক ইউনূস তাঁর সরকারের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করলেও, অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা এবং প্রকাশ্যে বিশ্বাস পালনের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার সময় (৫-৮ আগস্ট) এবং সরকার পতনের মুহূর্তে দেশে কার্যকর প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫-২০ আগস্টের মধ্যে ১,৭৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ২০টি সাম্প্রদায়িক হামলা ছিল। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো হয়, তবে কিছু মুসলিম শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ সংখ্যালঘু মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় রক্ষায় এগিয়ে আসেন।
আইনগত সীমাবদ্ধতা ও সাইবার নিরাপত্তা আইন: USCIRF প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকলেও দণ্ডবিধির ১৯৫এ ধারায় ধর্ম অবমাননার আইন এখনো বহাল আছে। একইসাথে, ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা এমন বিষয়বস্তুকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে, যা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। এসব অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সাংবিধানিক সংস্কার ও “ধর্মনিরপেক্ষতা” বিতর্ক: প্রতিবেদনে সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবনা ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় সংবিধানের প্রস্তাবনায় “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটি পরিবর্তন করে “বহুত্ববাদ” ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তবে বিএনপি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে “সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” বাক্য পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP) “বহুসংস্কৃতিবাদ” বা এর সমতুল্য কোনো বাংলা শব্দ ব্যবহারের প্রস্তাব করেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অভিযোগ করেছেন যে, তারা এই সংস্কার প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছেন এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রতিনিধিত্ব সীমিত।
নারী সংস্কার কমিশন ও রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া: নারী সংস্কার কমিশন নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করেছে, যার মধ্যে ধর্মভিত্তিক পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আইনের পরিপূরক হিসেবে একটি সিভিল কোড চালুর প্রস্তাব ছিল। হেফাজতে ইসলামের মতো কয়েকটি সংগঠন এসব প্রস্তাবকে “ইসলামবিরোধী” আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করেছে। চলতি বছরের মে মাসে হেফাজতে ইসলাম প্রায় ২০ হাজার সমর্থক নিয়ে ঢাকায় একটি সমাবেশ করে, যেখানে তারা নারী সংস্কার কমিশন বাতিল, সংবিধানে “আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” পুনঃস্থাপন এবং সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি: প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে রক্ষণশীল ইসলামপন্থী মতাদর্শের উপস্থিতি আগের তুলনায় দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে বলে কিছু নারী অভিযোগ করেছেন। ইউএসসিআইআরএফ সতর্ক করে বলেছে, আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ধর্মীয় উসকানিমূলক সহিংসতার আশঙ্কা রয়ে গেছে। তবে সরকার এখনো এ ধরনের সহিংসতা মোকাবিলায় কোনো পূর্ণাঙ্গ কৌশল উপস্থাপন করতে পারেনি, কেবল বাড়তি পুলিশ মোতায়েন ছাড়া।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ও জবাবদিহিতার অভাব: ইউএসসিআইআরএফ উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আবর্তিত হয়েছে। উভয় দলই রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও মুসলিম নারী জোর দিয়ে বলেছেন যে, তারা এখনো সমাজের বিভিন্ন স্তরে “কট্টরপন্থী ইসলামি গোষ্ঠীর” বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে হামলার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
ইউএসসিআইআরএফ-এর সুপারিশ: যুক্তরাষ্ট্রের এই কমিশন জোর দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য, যা ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তাদের মতে, সব ধর্মীয় সংখ্যালঘুর নিজ নিজ ধর্ম নির্ভয়ে ও প্রতিশোধের আশঙ্কা ছাড়াই পালন করার অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। সংবিধান সংস্কারের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেই কেবল একটি স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন সম্ভব হবে।