১৩ জুন ২০২৫, ১০:২৬:৩৮
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠককে ‘গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরের এনসিপির কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন, যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
‘দেশবাসীর স্বার্থ ও গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা’:
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী তার বক্তব্যে বলেন, “লন্ডনে বসে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মিটিং দেশবাসীর স্বার্থ ও গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা।” তিনি শহীদদের রক্তের অবমাননা করে বিদেশের মাটিতে এই ধরনের বৈঠক আয়োজনের তীব্র নিন্দা জানান। তার মতে, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার শুধুমাত্র এদেশের জনগণের, কোনো বিদেশি আলোচনায় নয়। উল্লেখ্য, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। দলটি দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে।
৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ ও ‘জাতীয় বন্দোবস্তের’ আহ্বান:
এনসিপির এই নেতা ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরের সামাজিক চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, সেটি কার্যকর না হওয়ায় দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় একটি নতুন ‘জাতীয় বন্দোবস্ত’ অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বন্দোবস্ত অবশ্যই জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে হতে হবে, কোনো একক দলের সুবিধার জন্য নয়।
দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থানের হুঁশিয়ারি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনীহা:
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি সরকার সংস্কার, বিচার এবং সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয়, তাহলে এনসিপি ‘দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থানের’ দিকে যেতে বাধ্য হবে। তিনি আরও জানান, এই সরকার যদি জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়, তাহলে এনসিপি কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না। তার মতে, শুধু ‘রাজা বা রানী বদল’ নয়, বরং কাঠামোগত পরিবর্তনই জরুরি। এনসিপি মনে করে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের লড়াই চলবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির প্রতি আহ্বান ও সমালোচনা:
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “শহীদদের আত্মত্যাগ ও আহতদের কষ্টের মূল্যায়ন করতে হবে। গ্রামের মানুষের কাছে যেতে হবে, জানতে হবে তারা কী চায়।” জনগণের বেদনা উপলব্ধি করতে পারলে বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়া গতি পাবে বলে তিনি মনে করেন।
অন্যদিকে, বিএনপির অবস্থান নিয়েও নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বিএনপি একসময় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানালেও এখন রোজার আগের সময়সীমায় এসে পৌঁছেছে। তবে তারা এখনো ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’, বিচার বা নতুন সংবিধান নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেয়নি। এতে বোঝা যায়, তারা কেবল ক্ষমতার লোভে যুক্ত হয়েছে এবং গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করছে না।
গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতা:
এনসিপি মুখ্য সমন্বয়ক আরও দাবি করেন, “অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি একযোগে দেশের জনগণকে পাশ কাটিয়ে একটি গভীর সংকট তৈরি করছে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকারই বৈধ হতে পারে না এবং জনগণ অতীতেও লড়াই করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর মতে, কেবল নির্বাচন করলেই হবে না, সঠিক বিচার ও সাংবিধানিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের কোনো অর্থ নেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে জনগণের আস্থার প্রতীক নয় বরং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ এনে তিনি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, আরপিও সংশোধন এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এই বৈঠককে ঘিরে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর এই কঠোর সমালোচনা সেই প্রত্যাশার বিপরীত চিত্রই তুলে ধরল। তার মন্তব্য দেশের বর্তমান রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার জন্ম দিয়েছে।