১০ জুন ২০২৫, ৫:৫৬:৩৬
দেশের একমাত্র অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ সরকারি চক্ষু হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, গত ১৪ দিন ধরে কার্যত বন্ধ। প্রায় ৬০০ কোটি টাকা মূল্যের এই প্রতিষ্ঠানটি এখন জুলাই আন্দোলনের আহতদের ‘আবাসিক হোটেলে’ পরিণত হয়েছে। সরকারের নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ থাকলেও, চিকিৎসা সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ।
গত ২৮ মে একটি ‘ভুল বোঝাবুঝি’কে কেন্দ্র করে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের উপর হামলার পর থেকেই এই অচলাবস্থা। নিরাপত্তার অভাবে কোনো কর্মী হাসপাতালে ফিরতে সাহস পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, এমনকি সেনাবাহিনী ও পুলিশের চেষ্টাও এই সংকট নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে।
আহতদের ‘আস্তানা’, বন্ধ সেবা:
হাসপাতালটির পরিষেবা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার মানুষ চোখের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আহতদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, “আমরা ঢাকায় এসে কোথায় থাকবো?” এই যুক্তিতে তারা হাসপাতাল ছাড়তে নারাজ। অথচ, দেশের সেরা চক্ষু বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড ৪ জুন হাসপাতাল পরিদর্শন করে আহতদের চিকিৎসা সন্তোষজনক উল্লেখ করে তাদের দ্রুত ছাড়পত্র (রিলিজ) ও পুনর্বাসনের সুপারিশ করেছে। কিন্তু আহতরা সেই সুপারিশ মানতে রাজি নন, এমনকি তাদের রিলিজের কাগজপত্রও ছিঁড়ে ফেলেছেন।
বিরল ঘটনা: চিকিৎসকদের অবরুদ্ধ করে দাবি আদায়!
মেডিকেল বোর্ড পরিদর্শনের পর জরুরি বিভাগ চালুর চেষ্টা হলেও তা টেকেনি। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় জুলাই আহতরা ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলমকে প্রায় ৬ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। বাধ্য হয়ে তাকে তাদের দাবি মেনে নিয়ে পুলিশি প্রটোকলে হাসপাতাল ছাড়তে হয়। চিকিৎসকদের অভিযোগ, এই আহতরা কেবল “বারগেনিং” করার জন্য হাসপাতালে থাকছেন এবং সরকার থেকে নানা সুবিধা আদায় করতে চাইছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের চিকিৎসাকেও “ভুয়া” আখ্যায়িত করে আমেরিকা বা ইউরোপে পাঠানোর দাবি তুলেছেন।
কেন এই দখলদারিত্ব? নেপথ্যের ৫ কারণ:
অনুসন্ধানে জুলাই আহতদের হাসপাতাল না ছাড়ার পেছনে পাঁচটি মূল কারণ উঠে এসেছে:
১. পুনর্বাসনের প্রলোভন: ইউরোপ-আমেরিকায় সেটেল হওয়া বা উপযুক্ত পুনর্বাসনের আশায় তারা হাসপাতালে থাকছেন। তাদের ধারণা, হাসপাতাল ছাড়লে সরকারের নজর হারাবেন।
২. অর্থনৈতিক ফায়দা: কতিপয় আহত অর্থের বিনিময়ে রোগী ভর্তি, অপারেশনের সিরিয়াল এগিয়ে দেওয়াসহ নানা তদবিরে জড়িয়ে পড়েছেন। এমনকি নিয়োগ ও টেন্ডারেও হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।
৩. নিরাপত্তাহীনতা: দু’জনের নামে মাদক মামলা থাকায় হাসপাতাল ছাড়লে গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন।
৪. রাজনৈতিক প্রভাব: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ছাত্র সমন্বয়ক ও এনসিপি নেতারা।
৫. ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা: ঢাকার বাইরে বাড়ি হওয়ায় কর্মসূত্র বা অন্য প্রয়োজনে ঢাকায় এসে থাকার জন্য হাসপাতালটিকে তারা বেছে নিচ্ছেন।
ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম নিশ্চিত করেছেন, “তাদের ঢাকায় থাকা দরকার। এখন হাসপাতালকে বেছে নিয়েছে থাকার জন্য।” তিনি আরও জানান, বেশিরভাগ জুলাই আহত ইতিমধ্যেই বাড়ি চলে গেলেও মাত্র ৪-৭ জন এখনো হাসপাতালে অবস্থান করছেন এবং তারা রিলিজ নিতে রাজি নন। তাদের চাওয়া, যখন খুশি এখানে এসে থাকতে ও খাবার পেতে।
বিশেষজ্ঞ ও কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ:
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান উভয়েই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন। তবে, তাদের মতে, পুনর্বাসনের কাজটি সহজ নয় এবং এটি একটি সংবেদনশীল ব্যাপার।
হাসপাতালের পরিচালক (ছুটিতে থাকা) অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী স্বীকার করেছেন, জুলাই আহতরা “অনেক বড় স্যাক্রিফাইস” করেছেন এবং তাদের সেরা চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, এমনকি বিদেশেও পাঠানো হয়েছে। তবে, তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, জুলাই আহতদের এখন বিশেষায়িত হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই, তাদের পুনর্বাসনই মূল বিষয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, “মাত্র কয়েকজন আহতের বিশৃঙ্খল আচরণের কারণে সারাদেশে জুলাই আহত ও পঙ্গুদের ত্যাগ বিতর্কিত হচ্ছে।” তিনি সরকার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র সমন্বয়কদের সম্মিলিতভাবে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
৬০০ কোটি টাকার অত্যাধুনিক এই হাসপাতালটি কবে নাগাদ তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরবে এবং দেশের মানুষ আবার চোখের উন্নত চিকিৎসা পাবে, সেটাই এখন হাজারো মানুষের প্রশ্ন। এই অচলাবস্থা দ্রুত নিরসন না হলে দেশের স্বাস্থ্যখাতে এর নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।