১৪ জুন ২০২৫, ১২:৩৯:৩০
প্রভাতী বার্তা ডেস্ক: বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটের গভীরতা ও সরকারের কঠোর অবস্থান আজ আরও একবার স্পষ্ট হলো। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগের কোনো সম্ভাবনা নেই, এমনকি ‘কেয়ামত’ পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও নয়। সরকারের মূল লক্ষ্য এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাতের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। শুক্রবার সকালে সিলেট গ্যাস ফিল্ড পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এই কঠোর বার্তা দেন।
জ্বালানি উপদেষ্টা তার বক্তব্যে দেশের গ্যাস উৎপাদন হ্রাসের alarming চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জানান, প্রতি বছর প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন কমছে, অথচ নতুন করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই বিশাল ঘাটতি পূরণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান আমদানি নির্ভরতা কমাতেই সরকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “আমরা এখানে এসেছি মূলত গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। পুরাতন কূপগুলোর ওয়ার্কওভার এবং নতুন কূপ খনন হচ্ছে সেগুলো দেখতে।” তিনি জানান, উৎপাদন বাড়াতে ভোলা ও জামালপুরে নতুন কূপ খননের কাজ চলছে এবং বিভিন্ন স্থানে ভূতাত্ত্বিক জরিপও চলমান। একটি নতুন অত্যাধুনিক রিগ কেনার প্রক্রিয়াও দ্রুত এগিয়ে চলছে, কারণ বর্তমান একটি রিগ দিয়ে প্রয়োজনীয় খনন কাজ সম্ভব হচ্ছে না।
দুই দিনের সিলেট সফরের প্রথম দিনে জ্বালানি উপদেষ্টা গোলাপগঞ্জের কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্রের নব-সংযুক্ত কৈলাশটিলা-৭ কূপ এবং এমএসটিই প্লান্ট পরিদর্শন করেন। গত এক মাস ধরে পরীক্ষামূলকভাবে কৈলাশটিলা-৭ ও সিলেট-১০ কূপ থেকে দৈনিক ৮ মিলিয়ন করে মোট ১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছিল। আজ উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকভাবে এই ১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেন, যা দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও স্বস্তি আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ফাওজুল কবির খানের উত্তর ছিল অত্যন্ত সরাসরি। তিনি বলেন, “আবাসিকে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও সম্ভাবনা নেই। আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতো, তাহলে আমি ঢাকা শহরেও আবাসিকে গ্যাস বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতাম।”
উপদেষ্টা তার এই কঠোর অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, “যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস মিলছে না, শিল্প কারখানায় গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না, সেখানে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহকে আমরা অপচয় মনে করি।” তিনি আরও যোগ করেন যে, বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের খরচ তার থেকে প্রাপ্ত আয়ের তুলনায় অনেক বেশি, যা এই খাতকে ‘ইনইফিসিয়েন্ট’ করে তুলেছে।
জ্বালানি উপদেষ্টা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বাসাবাড়িতে এখন থেকে এলপিজি গ্যাসই ব্যবহার করতে হবে। যেসব এলাকা থেকে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে, সেখানকার স্থানীয় জনগণের দীর্ঘদিনের গ্যাস সংযোগের দাবিও তিনি নাকচ করে দেন। পরিবর্তে, সেসব এলাকায় বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে (বাজারে যেখানে ১৪০০ টাকা, সেখানে ৮০০ টাকায়) এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান, “আপনারা সচেতনতা তৈরি করুন, আর বাসা বাড়িতে গ্যাস কেউ পাবেন না। এলপিজি এসে গেছে, আমরা দামও কমানোর চেষ্টা করছি।” তার বার্তা পরিষ্কার: এখন থেকে বাসা বাড়িতে এলপিজি এবং শিল্পকারখানায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের এই বক্তব্য বাংলাদেশের জ্বালানি নীতির এক নতুন দিক উন্মোচন করলো, যেখানে আবাসিক খাতকে সম্পূর্ণরূপে এলপিজি নির্ভর করার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং দেশের সীমিত গ্যাস সম্পদকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাতের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। শনিবার তিনি সিলেটের জাফলং ও ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি পরিদর্শনের মাধ্যমে তার সিলেট সফর শেষ করবেন।