সম্পাদকীয়

অর্থনীতিতে স্বস্তির সুবাতাস: রফতানি ও রেমিট্যান্সের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ!

৯ জুন ২০২৫, ২:৩১:২৭

A breath of relief in the economy: Bangladesh is recovering with the help of exports and remittances!
অর্থনীতিতে স্বস্তির সুবাতাস: রফতানি ও রেমিট্যান্সের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ!

প্রভাতী বার্তা রিপোর্ট: দেশের অর্থনীতিতে অবশেষে স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। রফতানি আয় ও প্রবাসী আয়ের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে (বিওপি) এসেছে উল্লেখযোগ্য উন্নতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিওপি ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৬ কোটি ডলারে, যা এক মাস আগেও ছিল ১০৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৫৭ কোটি ডলার এবং তার আগের বছর ছিল ৮২২ কোটি ডলার। অর্থাৎ, মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে বিওপি ঘাটতি প্রায় ৭৫০ কোটি ডলার কমেছে, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য এক বিশাল স্বস্তির খবর।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ফিরছে আস্থা

বিওপি পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। ২৯ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫.৮০ বিলিয়ন ডলারে, যা এক বছর আগে ছিল ২৪.২২ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম৬ পদ্ধতিতেও রিজার্ভ ২০.৫৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৮৫ কোটি ডলার বেশি। এটি দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা।

রফতানি আয়ে উল্লম্ফন: নতুন দিগন্তে বাংলাদেশের পণ্য

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের পণ্য রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৬৫৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮.৬১ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাক খাত বরাবরের মতোই রফতানির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। তবে আশার কথা হলো, কৃষিপণ্য, ওষুধ এবং হালকা প্রকৌশলপণ্যেও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ধাক্কা সামলেও ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের রফতানি বাজার ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে, যা দেশের রফতানি বহুমুখীকরণে একটি ইতিবাচক দিক।

রেমিট্যান্সে নতুন রেকর্ড: হুন্ডি কমে বৈধ চ্যানেলে অর্থপ্রবাহ

একই সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহও ঊর্ধ্বমুখী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন রেকর্ড ২৪.৫৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, হুন্ডির ব্যবহার কমে আসা, বৈধ চ্যানেলের ডিজিটালাইজেশন এবং সরকারের প্রণোদনা বৃদ্ধি রেমিট্যান্সের এই ইতিবাচক ধারার মূল কারণ। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, মে মাসেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল রেকর্ড পরিমাণ, যা এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ইঙ্গিত দেয়।

ঘাটতি কাটিয়ে উঠছে চলতি ও আর্থিক হিসাব

চলতি হিসাব (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স)-এর ঘাটতিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এই ঘাটতি ১৩৯ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা এক বছর আগে ছিল ৬৬১ কোটি ডলার। অন্যদিকে, আর্থিক হিসাব (ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) যেখানে বছরের শুরুতে ঘাটতি ছিল, সেখানে এখন ১৯৬ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। যদিও আগের বছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৪৫৪ কোটি ডলার, তবুও ঘাটতি কাটিয়ে ইতিবাচক অবস্থানে ফিরে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।

বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা: বাজারভিত্তিক নীতির সুফল

বাংলাদেশ ব্যাংক মে মাসে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করলেও ডলারের সরবরাহ বাড়ায় বিনিময় হারে তেমন অস্থিরতা দেখা যায়নি। ফলে টাকার মানও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য একটি ভালো লক্ষণ।

ভবিষ্যতের পথে করণীয়: স্থিতিশীলতা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতির এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে রফতানি বাজারে আরও বহুমুখীকরণ, প্রবাসী আয়ের ডিজিটাল চ্যানেল সম্প্রসারণ এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের পথও সুগম করতে হবে।

দেশের অর্থনীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছিল, রফতানি ও রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে লেনদেন ভারসাম্য ও রিজার্ভের এই ঘুরে দাঁড়ানো তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার বার্তা নিয়ে এসেছে। এই ইতিবাচক প্রবণতা ধরে রাখা গেলে আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।