সম্পাদকীয়

ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে নির্বাচন, নাকি রাজনৈতিক ঐকমত্যের সংকট?

৪ জুলাই ২০২৫, ৯:০৭:৫৯

Elections surrounding February, or a crisis of political consensus?

প্রভাতী বার্তা সম্পাদকীয়: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্তে ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সৃষ্ট অনিশ্চয়তা কাটছে না। বরং, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের গুঞ্জন এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জোরদার প্রস্তুতি নতুন করে আলোচনা ও সতর্কতার জন্ম দিয়েছে। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক থেকে ইঙ্গিত মিলেছিল যে, রমজান শুরুর আগেই (অর্থাৎ, সম্ভবত আগামী ফেব্রুয়ারিতে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। তবে, এর জন্য সংস্কার ও ‘জুলাই হত্যাযজ্ঞের’ বিচারের মতো মৌলিক বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি প্রয়োজন, যা এখন পর্যন্ত অধরা রয়ে গেছে।

নির্বাচনী ধোঁয়াশা ও ঐকমত্যের টানাপোড়েন:

সরকারের পক্ষ থেকে এখনো জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। অন্যদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মৌলিক কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাচ্ছে। ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে সরকারের আশাবাদ থাকলেও বিভিন্ন দলের অনড় অবস্থানে তা জটিল আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো এখনো একমত হতে পারেনি। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সম্ভাব্য নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বলে অসমর্থিত সূত্র জানালেও, সিইসি তা অস্বীকার করেছেন। এই পরিস্থিতি সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও ধোঁয়াশায় ফেলে দিয়েছে।

বিএনপির ফেব্রুয়ারিমুখী প্রস্তুতি ও কৌশল:

এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোট হতে পারে—এমনটা ধরে নিয়েই নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সরাসরিই গণমাধ্যমকে বলেছেন, “নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হচ্ছে।” তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতির দাবিগুলোকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান হিসেবে দেখছেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই নির্বাচনকে ‘কঠিন’ ধরে নিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি বিগত সরকারের আমলে দলের দুঃসময়ে নিষ্ক্রিয় থাকা বা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত নেতাদের এবার মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বদ্ধপরিকর। দলের পক্ষ থেকে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা’ প্রণয়ন করা হয়েছে, যার আলোকেই নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি হবে।

তবে, বিএনপির নির্বাচনী কৌশল নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তারা এককভাবে নাকি জোটগতভাবে নির্বাচন করবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর প্রতিদান দেওয়া এবং ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করার বিষয়ে আলোচনা হলেও, জোটের কাঠামো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ইসলামী আন্দোলনসহ আরও ২৩টি দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি জানাচ্ছে, যা বিএনপির সঙ্গে তাদের মতপার্থক্যকে স্পষ্ট করে।

রাজনৈতিক জটিলতা ও আগামীর পথ:

সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একতরফা নির্বাচন থেকে বের হয়ে আসার একটি প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যের অভাব প্রক্রিয়াটিকে শ্লথ করে দিচ্ছে। সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস এবং অনড় অবস্থান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।

একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনা এবং সমঝোতা অপরিহার্য। ‘ফেব্রুয়ারি’কে কেন্দ্র করে যেকোনো প্রস্তুতি যেন সংঘাতের জন্ম না দেয়, বরং তা যেন আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ প্রশস্ত করে, সেদিকে সকল পক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। দেশের স্থিতিশীলতা ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত রাজনীতির মূল লক্ষ্য।

আরও খবর:

বিবিধ