রাজনীতি

ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশ: পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি

২৯ জুন ২০২৫, ২:২৬:৪৮

Islamic Movement's Grand Gathering: Demand for Elections through PR Method
রাজধানীতে শনিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশ

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন ও পিআর পদ্ধতির দাবি: ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে ১৬ দফা ঘোষণা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সব স্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার (২৮ জুন) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলটির বিশাল মহাসমাবেশ থেকে এই দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করা হয়। এই মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টি এবং গণ অধিকার পরিষদের নেতারাও একই দাবির প্রতি সমর্থন জানান।

সংস্কার, বিচার ও পিআর পদ্ধতির স্লোগান:

সংস্কার, বিচার এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে এবং দেশ ও ইসলামবিরোধী সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের প্রতিবাদে এই মহাসমাবেশের আয়োজন করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। মহাসমাবেশে দলটি ১৬ দফা দাবি সংবলিত একটি ঘোষণাপত্র পেশ করে। এই ১৬ দফা ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচন গ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মী খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হতে শুরু করেন। দুপুর নাগাদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হাতপাখা আর সাদা পোশাকের জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন এবং মৎস্য ভবন এলাকার সড়কেও দলটির নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

বেলা দুইটায় শুরু হয় মূল অধিবেশন, যেখানে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি আমন্ত্রিত অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতারা বক্তব্য দেন। তবে, এই সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

পিআর পদ্ধতির অপরিহার্যতা:

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই বলে জোর দিয়ে বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষেই এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। এটি হলে কোনো দল ‘জালেম’ হওয়ার সুযোগ পাবে না। তিনি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিকে ‘জনগণের দাবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ও ইসলামপন্থীদের ঐক্য:

সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম রাজনৈতিক চাঁদাবাজি এখনও চলছে মন্তব্য করে বলেন, “একটি দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। কারও নাম ধরে সমালোচনা করতে চাই না। তবে পুরোনো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি জিইয়ে রাখার চেষ্টা সহ্য করা হবে না।”

ইসলামপন্থী দলগুলোকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা ৫৪ বছরে অনেক দলকে দেশ শাসন করতে দেখেছি; কিন্তু ইসলামকে ক্ষমতায় নিতেই পারিনি। এবার ইসলামপন্থীদের ঐক্যের ব্যাপারে গণপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।”

প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন:

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “আপনি জাতির উদ্দেশে এক কথা বলবেন, সরকারপ্রধান হিসেবে এক কথা বলবেন, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক কথা বলবেন, কিন্তু কোনো দলের সঙ্গে আলোচনায় গিয়ে সে কথা ভুলে যাবেন। এটা নিরপেক্ষতা ভঙ্গ হয়েছে।” তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে আগামী ৮-১০ মাসের মধ্যে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে আহ্বান জানান। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া বাংলার মানুষ কোনো নির্বাচন গ্রহণ করবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

নতুন সংবিধান ও আঞ্চলিক ঐক্যের দাবি:

এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচনের দাবি জানান। তিনি বলেন, “নির্বাচন চান; কিন্তু পিআর মানেন না কেন? নির্বাচন চান; কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে আপনাদের অসুবিধা কী? সুতরাং আমরা এই টালবাহানা চলতে দিতে চাই না।” এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন মুজিববাদী সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানান।

বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে হিন্দু সম্প্রদায় ভোট দিতে যাবে, না হলে যাবে না বলে উল্লেখ করেন এবং একই সঙ্গে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতিরও দাবি জানান।

ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশ

১৬ দফা দাবিনামা:

মহাসমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান যে ১৬ দফা দাবিসমূহ পাঠ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিরূপে পুনঃস্থাপন, সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, জুলাই সনদের ঘোষণা ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণে জাতীয় ঐকমত্য, ভবিষ্যৎ স্বৈরাচার ও দলীয় কর্তৃত্ববাদ রোধে মৌলিক রাষ্ট্র সংস্কার, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে ফ্যাসিবাদী প্রভাবমুক্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার ও পলাতক অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার কূটনৈতিক পদক্ষেপ, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও খুন-খারাবি রোধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা, ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তি প্রকাশ ও দেশবিরোধী চুক্তির বাতিল, জাতীয় নির্বাচনের আগে সব পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন, দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও সন্ত্রাসীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিবেশ নিশ্চিত করা, ঘুষ-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী কর্মকাণ্ডে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজদের প্রতিহত করা, এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামের আলোকিত আদর্শ বাস্তবায়নের আহ্বান।

মহাসমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ, খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মূসা বিন ইজহার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া ও বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও বক্তব্য দেন।

আরও খবর:

বিবিধ