আজকাল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন। যোগাযোগের পাশাপাশি ছবি তোলার ক্ষেত্রেও এর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। অনেকেই হয়তো ভাবেন, ভালো ছবি তোলার জন্য দামি ডিএসএলআর ক্যামেরাই অপরিহার্য। কিন্তু সত্যিটা হলো, আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোনটি দিয়েই তোলা সম্ভব অসাধারণ সব ছবি, যদি জানা থাকে কিছু কৌশল। চলুন, জেনে নেওয়া যাক স্মার্টফোনে ভালো ছবি তোলার কিছু কার্যকরী উপায়।
১. আলোর সঠিক ব্যবহার:
ফটোগ্রাফির মূল ভিত্তি হলো আলো। স্মার্টফোনে ভালো ছবি তোলার প্রথম শর্তই হলো পর্যাপ্ত ও সঠিক আলোর ব্যবহার।
প্রাকৃতিক আলো: দিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলোতে ছবি তোলার চেষ্টা করুন। সরাসরি কড়া রোদ এড়িয়ে সকালের নরম আলো বা বিকেলের পড়ন্ত আলোতে ছবি তুললে দারুণ ফলাফল পাওয়া যায়।
আলোর উৎস: সাবজেক্ট বা বিষয়বস্তুর দিকে যেন আলোর উৎস থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। সাবজেক্টের পেছনে শক্তিশালী আলো থাকলে ছবিটি অন্ধকার (সিলুয়েট) হয়ে যেতে পারে, যদি না আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে সিলুয়েট তুলতে চান।
কৃত্রিম আলো: কম আলোতে ছবি তোলার সময় ফোনের ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে আশপাশের অন্য কোনো আলোর উৎস (যেমন ল্যাম্প, মোমবাতি) কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। ফ্ল্যাশের আলো অনেক সময় ছবিকে অস্বাভাবিক ও ফ্ল্যাট করে দেয়।
২. লেন্স পরিষ্কার রাখুন:
স্মার্টফোন আমরা সারাদিন নানা কাজে ব্যবহার করি, ফলে এর ক্যামেরার লেন্সে সহজেই আঙুলের ছাপ, ধুলোবালি জমতে পারে। অপরিষ্কার লেন্স আপনার ছবির মান অনেকটাই কমিয়ে দেবে, ছবি ঝাপসা বা ঘোলাটে আসতে পারে। তাই ছবি তোলার আগে একটি নরম, পরিষ্কার কাপড় (মাইক্রোফাইবার ক্লথ হলে ভালো) দিয়ে লেন্স মুছে নিন।
৩. ফোকাস ঠিক করুন:
ভালো ছবির জন্য সঠিক ফোকাস অপরিহার্য। বেশিরভাগ স্মার্টফোনেই এখন অটোফোকাস সুবিধা থাকে। তবে, আপনি যে বিষয়বস্তুর উপর ফোকাস করতে চান, সেটি স্ক্রিনে আঙুল দিয়ে আলতো করে ট্যাপ করে ম্যানুয়ালিও ফোকাস করতে পারেন। এতে আপনার ছবির মূল আকর্ষণ স্পষ্ট ও নিখুঁত হবে।
৪. কম্পোজিশন ও ফ্রেমিং:
ছবির বিষয়বস্তুকে কীভাবে ফ্রেমে সাজাচ্ছেন, তার উপর ছবির সৌন্দর্য во многом নির্ভর করে।
রুল অফ থার্ডস (Rule of Thirds): এটি ফটোগ্রাফির একটি জনপ্রিয় নিয়ম। আপনার ফোনের স্ক্রিনকে কাল্পনিকভাবে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি দুটি করে রেখা দিয়ে মোট নয়টি সমান ভাগে ভাগ করুন। মূল সাবজেক্টকে এই রেখাগুলোর সংযোগস্থলে বা রেখা বরাবর স্থাপন করলে ছবিটি দেখতে আকর্ষণীয় লাগে। অনেক স্মার্টফোনের ক্যামেরা অ্যাপে এই গ্রিডলাইন চালু করার অপশন থাকে।
লিডিং লাইনস: ছবিতে এমন কিছু রেখা (যেমন রাস্তা, নদীর তীর, বেড়া) ব্যবহার করুন যা দর্শকের চোখকে ছবির মূল আকর্ষণের দিকে নিয়ে যায়।
ফ্রেমিং: দরজার ফ্রেম, জানালা বা গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে ছবি তুললে তা ছবিতে একটি গভীরতা ও ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
৫. ফোনের ক্যামেরা সেটিংস ও মোডগুলো জানুন:
অধিকাংশ স্মার্টফোনের ক্যামেরা অ্যাপে বিভিন্ন সেটিংস ও মোড (যেমন – পোর্ট্রেট, নাইট মোড, প্যানোরামা, প্রো/ম্যানুয়াল মোড) থাকে।
পোর্ট্রেট মোড: এই মোডে সাবজেক্টকে ফোকাসে রেখে পেছনের অংশ (ব্যাকগ্রাউন্ড) সুন্দরভাবে ঝাপসা (বোকেহ ইফেক্ট) করা যায়, যা ডিএসএলআর ক্যামেরার মতো লুক দেয়।
নাইট মোড: রাতের বা কম আলোর ছবি তোলার জন্য এটি খুবই কার্যকরী। এই মোডে ফোন একাধিক ছবি তুলে সেগুলোকে একত্রিত করে একটি উজ্জ্বল ও পরিষ্কার ছবি তৈরি করে।
প্রো/ম্যানুয়াল মোড: যারা ছবি তোলার বিভিন্ন সেটিংস (শাটার স্পিড, আইএসও, হোয়াইট ব্যালান্স) নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তাদের জন্য এই মোডটি দারুণ। এটি আয়ত্ত করতে পারলে ছবির উপর আপনার আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
৬. ডিজিটাল জুম এড়িয়ে চলুন:
স্মার্টফোনে সাধারণত দুই ধরনের জুম থাকে – অপটিক্যাল জুম ও ডিজিটাল জুম। অপটিক্যাল জুম ছবির মান ঠিক রেখে সাবজেক্টকে কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু ডিজিটাল জুম মূলত ছবিকে ক্রপ করে বড় করে, ফলে ছবির মান নষ্ট হয় ও পিক্সেল ফেটে যায়। তাই পারতপক্ষে ডিজিটাল জুম এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজন হলে সাবজেক্টের কাছাকাছি গিয়ে ছবি তুলুন।
৭. স্থিরতা জরুরি:
ছবি তোলার সময় ফোন স্থির রাখুন। হাত সামান্য কাঁপলেও ছবি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে কম আলোতে। দুই হাতে ফোন ধরুন এবং শ্বাস স্বাভাবিক রেখে শাটার বাটনে আলতো চাপ দিন। সম্ভব হলে ছোট ট্রাইপড বা কোনো কিছুর উপর ফোন রেখে ছবি তুলুন।
৮. বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলুন:
একই বিষয়বস্তুর ছবি বিভিন্ন কোণ (অ্যাঙ্গেল) থেকে তোলার চেষ্টা করুন। সাধারণ আই-লেভেল (চোখের উচ্চতা) ছাড়াও কখনো লো-অ্যাঙ্গেল (নিচ থেকে উপরের দিকে) বা হাই-অ্যাঙ্গেল (উপর থেকে নিচের দিকে) থেকে ছবি তুলুন। এতে আপনার ছবিতে নতুনত্ব আসবে।
৯. ছবি সম্পাদনা (এডিটিং):
ছবি তোলার পর হালকা সম্পাদনা ছবির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। ফোনের বিল্ট-ইন এডিটর বা বিভিন্ন থার্ড-পার্টি অ্যাপ (যেমন – Snapseed, Lightroom Mobile) ব্যবহার করে ছবির ব্রাইটনেস, কনট্রাস্ট, স্যাচুরেশন, শার্পনেস ইত্যাদি ঠিক করে নিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন, অতিরিক্ত এডিটিং যেন ছবির স্বাভাবিকতা নষ্ট না করে।
১০. অনুশীলন, অনুশীলন এবং আরও অনুশীলন:
যেকোনো শিল্পেই দক্ষতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি হলো অনুশীলন। যত বেশি ছবি তুলবেন, বিভিন্ন সেটিংস ও কম্পোজিশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন, ততই আপনার দক্ষতা বাড়বে। নিজের তোলা ছবিগুলো বিশ্লেষণ করুন, দেখুন কোথায় আরও ভালো করা যেত।
উপরে দেওয়া টিপসগুলো অনুসরণ করলে এবং নিয়মিত অনুশীলন করলে আপনার স্মার্টফোনটিও হয়ে উঠতে পারে দারুণ ছবি তোলার মাধ্যম। মনে রাখবেন, দামি ক্যামেরার চেয়েও জরুরি হলো ফটোগ্রাফির মৌলিক বিষয়গুলো বোঝা এবং সৃজনশীলতার সঠিক প্রয়োগ। তাই আপনার স্মার্টফোনটি হাতে নিন আর বেরিয়ে পড়ুন আপনার চারপাশের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দী করতে!
www.provatibarta.net www.facebook.com/provatibarta.online www.youtube.com/@ProvatiBarta