৭ জুলাই ২০২৫, ১:০০:৫৮
‘জুলাই সনদ’: প্রত্যাশা, বিতর্ক আর অনিশ্চয়তার দোলাচলে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক। গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) মাসব্যাপী দফায় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে গেলেও, বহু মৌলিক বিষয়ে এখনো মতপার্থক্য কাটেনি। এই ‘সনদ’ আসলে কী, কেন এটি নিয়ে এত তোলপাড়, এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে—এসব প্রশ্ন এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান আলোচনার বিষয়।
‘জুলাই সনদ’ আসলে কী?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষ্যমতে, ‘জুলাই সনদ’ হলো একটি প্রতিশ্রুতি—একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো থেকে আসা প্রস্তাবনার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর যেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে, তার একটি তালিকা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্র সংস্কারে যে ১১টি কমিশন গঠন করেছিল, তাদের দেওয়া সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার-সংক্রান্ত মোট ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে এনসিসি গত কয়েক মাস ধরে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের (যার মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অন্যান্য দল রয়েছে) সাথে ধারাবাহিক সংলাপ চালাচ্ছে।
এনসিসি জানিয়েছে, এই ১৬৬টি প্রস্তাবনার মধ্যে ৮০টিরও বেশি বিষয়ে দলগুলো সামগ্রিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। পরবর্তীতে আরও ২০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে, যার মধ্যে ৫টিতে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এনসিসির সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এটিকে ‘জাতীয় সনদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দালিলিক ভিত্তি হিসেবে আগামী দিনের রাজনীতিতে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
ঐকমত্যের পথে বাধা কোথায়?
এনসিসি কিছু বিষয়ে ঐকমত্য অর্জনের দাবি করলেও, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো তীব্র মতবিরোধ বিদ্যমান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
অধ্যাপক আলী রীয়াজ স্বীকার করেছেন, প্রায় ৬-৭টি বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন, “সব বিষয়েই যদি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে শতভাগ একমত হতে হয়, তবে আলোচনার কি প্রয়োজন ছিল?” বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, সব ইস্যুতে সবাই একমত হবে না, কারণ প্রতিটি দলই চায় তাদের নিজস্ব দাবিগুলো সনদে অন্তর্ভুক্ত হোক, যা ঐকমত্যের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
এছাড়াও, ‘জুলাই সনদ’ (যা এনসিসি তৈরি করছে) এবং ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ (যা গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রকাশ করতে চেয়েছিল এবং এনসিপি এখনো প্রকাশের কথা বলছে) এর মধ্যে পার্থক্য নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। এনসিসি স্পষ্ট করেছে যে, জুলাই সনদ তাদের তৈরি করার বিষয়, আর ঘোষণাপত্র তৈরি হবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে।
বাস্তবায়নের পথ ও দ্বিধা-বিভক্তি:
জুলাই সনদ চূড়ান্ত হলে সেটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। এনসিসি বাস্তবায়নের জন্য ৬টি বিকল্প প্রস্তাব করেছিল: নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশ, নির্বাচনের আগে বা সময় গণভোট, গণপরিষদ, নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কার, এবং নির্বাচিত সংসদ।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই দ্বিধা-বিভক্ত অবস্থান জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই বিষয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলেন, এনসিসি ‘কী’ পরিবর্তন করা দরকার, তা চূড়ান্ত করে দিতে পারে; ‘কীভাবে’ বাস্তবায়ন হবে, তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো মিলে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আশাবাদী যে, ঐকমত্যে সনদ তৈরি হলে দলগুলো বাস্তবায়নের একটি পথ খুঁজে বের করতে পারবে।
সব মিলিয়ে, ‘জুলাই সনদ’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হতে চলেছে। তবে, এর চূড়ান্ত রূপ, সকল দলের গ্রহণযোগ্যতা এবং সর্বোপরি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখনো এক জটিল সমীকরণের মুখোমুখি। রাষ্ট্র সংস্কারের এই মহৎ উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পারস্পরিক ছাড় এবং একটি স্থিতিশীল ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর।