ধর্ম

আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা: মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও আল্লাহর আনুগত্যের আহ্বান

৬ জুন ২০২৫, ৪:৩৩:৪০

Hajj sermon at Arafat A call for unity among the Muslim Ummah and obedience to Allah
হজের খুতবা দিচ্ছেন শায়খ ড. সালেহ বিন হুমাইদ। ছবি: সংগৃহীত

প্রতি বছরের মতো এবারও পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়েছে আরাফাতের ময়দানে। গত বৃহস্পতিবার (৫ জুন) মক্কার মসজিদুল হারামের খতিব ও সৌদি আরবের প্রভাবশালী আলেম শায়েখ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ হজের খুতবা প্রদান করেন। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে শুরু হয়ে এই খুতবা চলে ৩টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত। বিশ্বের লাখো হাজির কাছে খুতবার বার্তা পৌঁছে দিতে এবার বাংলাসহ প্রায় ৩৫টি ভাষায় এটি অনুবাদ করে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

হজের খুতবার মূল বার্তা: আল্লাহর আনুগত্য ও সামাজিক সম্প্রীতি

শায়েখ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ তার খুতবায় মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান আনা এবং তার ইবাদতে একনিষ্ঠ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করতে হবে যেন আমরা তাকে দেখছি, অথবা এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে আল্লাহ আমাদের দেখছেন। সৎকর্মশীলদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে মঙ্গল রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোর ওপর জোর দেন:

  • ঈমান: মুখে স্বীকার, অন্তরে বিশ্বাস এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা আমল করা। এর ৭০টিরও বেশি শাখা রয়েছে, যার সর্বোচ্চ হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং সর্বনিম্ন হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার, সত্য কথা বলা এবং উত্তম চরিত্র ধারণকে ঈমানের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
  • সালাত (নামাজ): বান্দা ও রবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকারী এবং অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। জামাতে সালাত সমাজের বন্ধন দৃঢ় করে।
  • যাকাত: অর্জিত সম্পদের একটি অংশ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা। এটি মনকে কৃপণতা থেকে পবিত্র করে, অভাবীদের প্রয়োজন মেটায় এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করে।
  • সিয়াম (রোজা): ধৈর্য, কুপ্রবৃত্তির প্রতিরোধ, অভাবগ্রস্তদের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং আত্মাকে খারাপ অভ্যাস থেকে মুক্ত করার শিক্ষা দেয়।
  • হজ: আখেরাতের স্মরণ, আল্লাহর প্রতি মহব্বত সৃষ্টি এবং বিনয় ও সন্তুষ্টির সাথে তার আদেশ মেনে চলার শিক্ষা। হজের সময় অশ্লীল কথা, পাপাচার ও ঝগড়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না। শয়তান মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উসকানি দেয়, তাই উত্তম আচরণের মাধ্যমে মন্দকে প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়। ধৈর্য ধারণ, নেয়ামত লাভের সময় শুকরিয়া আদায় এবং পাপের পর তওবা ও অনুশোচনা করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।

খুতবায় আরাফাতের ময়দানের গুরুত্ব তুলে ধরে শায়েখ বলেন, এটি এমন একটি দিন যেদিন আল্লাহ অগণিত মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এদিনে হাজিদের বেশি বেশি আল্লাহর প্রশংসা, স্মরণ এবং দোয়া করার আহ্বান জানানো হয়।

খুতবার পর হাজিরা জোহর ও আসরের নামাজ একত্রে ও সংক্ষিপ্ত করে আদায় করেন। সূর্যাস্তের পর তারা মুজদালিফার দিকে রওনা হন, যেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে আদায় করে ভোর পর্যন্ত রাত্রি যাপন করেন। পরদিন ফজরের নামাজ শেষে তারা মিনার জামারাতে গিয়ে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন, কোরবানি করেন এবং মাথা মুণ্ডন করে তাওয়াফে ইফাদা সম্পন্ন করেন। এরপর মিনায় ফিরে এসে তাশরিকের তিন দিন অবস্থান করেন এবং প্রতিদিন ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন।

ফিলিস্তিনের মুসলিমদের জন্য দোয়া এবং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য

খুতবায় ফিলিস্তিনের মুসলিম ভাইদের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। তাদের সার্বিক তত্ত্বাবধান, আহার দান, বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়, ভীতদের নিরাপত্তা এবং শত্রুদের অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয়। মুসলিম শাসকদেরকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করার জন্যও দোয়া করা হয়।

শায়েখ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববন্ধন রক্ষা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সমাজে সম্প্রীতি সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সৌদি আরবের নেতৃত্ব হারামাইন শরীফাইন ও পবিত্র স্থানসমূহের সার্বিক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে হাজিরা শান্তি ও স্বস্তির সাথে তাদের দ্বীনি আচার অনুষ্ঠান পালন করতে পারেন। একজন মুসলমানের উচিত হজ সম্পর্কিত নিয়মাবলি ও আইনকানুন যথাযথভাবে মেনে চলা, যা শরীয়তের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং সভ্য আচরণের প্রতিফলন ঘটায়।