৪ জুন ২০২৫, ২:০৬:১১
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘কিছুটা গতানুগতিক’ হিসেবে স্বীকার করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি দৃঢ়তার সাথে জানিয়েছেন, এই বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব এবং এটি রাতারাতি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার পরিবর্তে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ অন্যান্য উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ শুরুতেই দেশের অর্থনীতির “আইসিইউতে” থাকার পূর্ববর্তী পরিস্থিতি স্মরণ করে বলেন, “বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সে সময় আমরা যদি দায়িত্ব না নিতাম, তাহলে কী যে হতো…! সবাই মিলে দেশকে এখন একটা স্থিতিশীল অবস্থানে নিয়ে আসতে পেরেছি।” তিনি জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক ও জ্বালানি খাতের সমস্যা, এবং রাজস্ব আদায়ের খারাপ পরিস্থিতির মতো চ্যালেঞ্জের মধ্যেই এই বাজেট প্রণয়ন করতে হয়েছে। সীমিত সম্পদ ও অগণিত চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রেখে, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে।
তার প্রশ্ন, এত দিন যে প্রবৃদ্ধির বয়ান শোনা গেছে, তার সুবিধা কে পেয়েছে? এই বাজেট প্রণয়নের মূল লক্ষ্য মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “তা বিবেচনা করে দেখা হবে। বলছি না যে টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে ভালো কিছু করে ফেলেছি।” জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান স্পষ্ট করেন যে, প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা সাদা করার জন্য আগের মতো কোনো বিশেষ সুযোগ নেই। তবে দুটি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে: নিজের জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে বাড়ি তৈরি করলে দ্বিগুণ কর এবং ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে পাঁচ গুণ কর দিয়ে তা ব্যবহার করা যাবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অর্থ উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন যে, অর্থ পাচারকারীরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সহজ নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার চলে যাওয়ার পর যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসবে, তাদের উদ্দেশে তিন উপদেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা জানান, বর্তমানে যে সংস্কারগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো চলমান থাকবে এবং এই সরকার একটি “পদচিহ্ন” রেখে যাবে, যা পরবর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য হচ্ছে ঋণের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা। বর্তমানে যেসব প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই আগের সরকারের নেওয়া “জঞ্জাল”, যা বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল এবং অর্থ সংস্থানও বিবেচনা করা হয়নি। তিনি বলেন, “আমরা হঠাৎ করে এক বছর বা দেড় বছরের জন্য এসেছি। এই সময়ের মধ্যে চেষ্টা করা হয়েছে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার।”
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন মন্তব্য করেন, “আগের প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন যে মার্চ বা এপ্রিলে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। এতেই প্রমাণিত হয় অর্থনীতি তখন খাদের কিনারায় ছিল। সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হয়েছে।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, বর্তমান সরকারের নেওয়া সংস্কার পদক্ষেপগুলো পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যদি ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, তাহলে অগ্রগতি অনেক দূর পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার—এই দুটি ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে এবং আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে তিনি আশাবাদী। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খাদ্যপণ্যের দাম কমা এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে বাজেটে নির্ধারিত ৬.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও মূল্যস্ফীতি আরও বেশি কমবে বলে তিনি মনে করেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবারের বাজেটকে ‘অপচয় ও অসংগতি কমানোর বাজেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি জানান, সড়ক বিভাগ থেকে চাঁদাবাজি সীমিত করতে পুলিশের সঙ্গে কাজ চলছে এবং বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে বিদ্যুৎ, এলপিজি এবং জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে, যা গাড়ি ভাড়া কমাতেও সহায়তা করবে।
বেলা তিনটায় শুরু হওয়া এই সংবাদ সম্মেলন প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে। অর্থ উপদেষ্টা প্রথম ৩০ মিনিট বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন এবং পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে অন্যান্য উপদেষ্টা, গভর্নর ও দুই সচিবকে জবাব দেওয়ার সুযোগ দেন। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই সংবাদ সম্মেলন শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেক সাংবাদিক প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি।
সব মিলিয়ে, নতুন বাজেট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থানে নিয়ে আসার একটি সতর্ক পদক্ষেপ বলে মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের প্রত্যাশা, এই বাজেট দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় একটি মজবুত ভিত্তি স্থাপন করবে।